ভোলা জেলার ইতিবৃত্ত
গাঙ্গেয় অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত দেশের একমাত্র দ্বীপ ভোলা । বর্তমান ভোলা একদা বৃহত্তর বরিশাল জেলার একটি মহকুমা ছিল। ১৮৫৪ সালে দ্বীপটি মহকুমায় উন্নীত হয়। ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলার মর্যাদা পায়। ভোলার আদি নাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর। চারদিকে নদী পরিবেষ্টিত এ জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আবহমান বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতোই। এলাকার কিংবদমত্মী, মসজিদ মন্দিরের স্থাপত্য ও নানা ঐতিহাসিক নিদর্শণ বিশেষণ করলে অনুমিত হয় এ জনপদ মাত্র ৭/৮ শত বছর আগে সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। মহারাজা কন্দর্প নারায়ণের কণ্যা বিদ্যাসুন্দরী ও কমলা রাণীর দিঘির ইতিহাস এ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতির একটি অংশ। এ দিঘির কাহিনী নিয়ে সুদুর তামিলনাড়ুর নিম্নাঞ্চলে এখনও গান পরিবেশিত হয়। মেঘনা, তেঁতুলিয়া বিধৌত বঙ্গোপসাগরের উপকুলে জেগে ওঠা প্রায় ৯০ মাইল দৈর্ঘ্য ও ২৫ মাইল প্রস্থ বিশিষ্ট এ ভূখন্ডের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যেদিকে চোখ যায় সব দিকে শুধু সমতল ভূমি। ফসলের দোলায়মান দিগমত্ম বিসত্মৃত মাঠ দেখে মানুষের মনে জেগে ওঠে বাউলের গান ও রাখালের বাঁশীতে ভর করে মোহনীয় সুর। প্রাকৃতিক সুষমামন্ডিত এ এলাকার গাছ গাছালী, পাখীর কুজন বারমাসী ফলমূল সত্যিই উলেস্নখযোগ্য।
হিমালয় থেকে নেমে আসা ৩টি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র বাহিত পলি দিয়ে মোহনায় গড়ে উঠেছে এ দ্বীপ। সমুদ্র সমতল থেকে এর গড় উচ্চতা ১২ ফুটের মতো। নৃ-তত্ত্ব ও ভূ-তত্ত্ববিদরা মনে করেন ‘‘পূর্ব দিকে মেঘনা ও পশ্চিম দিকে তেঁতুলিয়া নদী বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে গতিবেগ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ শামত্ম স্থানটিতে কালক্রমে পলি ও নদীতে বয়ে আসা বর্জ্য জমা হয়ে আজকের ভোলা নামক দ্বীপটির জন্ম।’’
ভোলার জন্ম খুব বেশি দিনের নয়। আনুমানিক ১২৩৫ সালের দিকে দ্বীপটি গড়ে ওঠতে শুরম্ন করে। এখানে প্রথম চর পড়া শুরম্ন হয় ১২৩৫ সালের দিকে এবং ১৩০০সালের দিকে চাষাবাদ শুরম্ন হয় বলে জে. সি. জ্যাক বাকেরগঞ্জ গেজেটিয়ারে উলেস্নখ করেন। এলাকার ধান, চাল, সুপারি, নারিকেল ও অন্যান্য প্রাচুর্যে প্রলুব্দ হয়ে একের পর এক বিদেশী শাসক ও পর্তুগীজ জলদস্যুরা এসেছে এখানে। ১৫০০ সালের দিকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের নজর পড়ে এ দ্বীপটির ওপর। তারা দ্বীপটিকে ঘাঁটি বানিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিঘ্নে লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে। এছাড়াও আরাকানের বর্গি ও মগরা দক্ষিণ শাহবাজপুরসহ আশেপাশের দ্বীপকে ঘাটি বানিয়ে লুটপাট চালিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করে রাখত। এরই প্রেক্ষাপটে সম্ভবত রচিত হয়েছিল -
‘‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিব কিসে ?
ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি ? আর কটা দিন সবুর কর রসূন বুনেছি’’-
১৫১৭ সালে জন ডি সিলবেরা নামক জনৈক পর্তুগীজ জলদস্যু দ্বীপটি দখল করে। পর্তুগীজদের রেখে যাওয়া ভীম দর্শণ কিছু রোমশ কুকুর আজও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে সেসব লোমহর্ষক অত্যাচারের কাহীনি স্মরণ করিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য মনপুরা ছিল এদের দস্যুবৃত্তির লীলাক্ষেত্র।
১৮ শতকে দক্ষিণ শাহবাজপুরের আয়তন ছিল মাত্র ২৫২ বর্গমাইল। ১৮২২সাল পর্যমত্ম শাহবাজপুর ছিল বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ। উনিশ শতকের প্রথমভাগে মেঘনার শাখা ইলিশা ও তেঁতুলিয়া বৃহত্তর আকার ধারণ করে। ফলে ভয়ংকর কালাবঁদর নদী পাড়ি দিয়ে নৌকা পথে জেলা সদর দফতরের সাথে দক্ষিণ শাহবাজপুরের যোগাযোগ রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই সরকার সিদ্বামত্ম নেয় বাকেরগঞ্জ হতে দক্ষিণ শাহবাজপুর ও হাতিয়াকে নোয়াখালীর অমর্ত্মভূক্ত করার। ১৮২২ সালের ২২ এপ্রিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দক্ষিণ শাহবাজপুরকে নোয়াখালীর অমর্ত্মভূক্ত করার সুপারিশ করেন এবং ঐ বছর ৩ জুলাই নোয়াখালীর জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট এইচ, পারকার দক্ষিণ শাহবাজপুরের দায়িতব বুঝে নেন। ১৮৬৯ সাল পর্যমত্ম ভোলা নোয়াখালীর অধীনে ছিল।
ভোলা জেলার নামকরণের পেছনে স্থানীয়ভাবে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। ভোলা শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতুয়া নামক খালটি এখনকার মতো অপ্রশসত্ম ছিলনা। একসময় এটি পরিচিত ছিল বেতুয়া নদী নামে। খেয়া নৌকার সাহায্যে নদীতে পারাপার চলতো। খুব বুড়ো এক মাঝি এখানে খেয়া নৌকার সাহায্যে লোকজন পারাপার করতো। তার নাম ছিল ভোলা গাজী পাটনী। আজকের যোগীরঘোলের কাছেই তার আসত্মানা ছিল। এই ভোলা গাজীর নামানুসারেই এক সময় স্থানটির নাম হয় ভোলা। ভোলার অন্যান্য উপজেলাও বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নামকরণ করা হয় যেমন দৌলতখাঁ, তজুমুদ্দি, বোরহানউদ্দিন ও লালমোহন।
প্রাকৃতিক অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও ভোলাবাসী এখনও আশার আলো দেখতে চায়। এ নৈস্বর্গিক দ্বীপ ভোলা জেলায় মূল্যবান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ শুধু জেলাবাসীর জন্যই নয় সমগ্র দেশের জন্য আশানুরূপ সুফল বয়ে আনার প্রত্যাশা রাখে। এ জেলায় উৎপাদিত রূপালী ইলিশ ভোলা বাসীর চাহিদা পূর্ণ করে দেশের অন্যান্য জেলায় এমনকি বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সপ্তম হয়েছে। চরফ্যাশন,তজুমুদ্দিনসহ অন্যান্য উপজেলায় উৎপাদিত বাগদা চিংড়ি চাষের মাধ্যমে ইতোমধ্যে অনেক মৎস্য চাষী মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের সুফল বয়ে এনেছেন। বোরহানউদ্দিন উপজেলায় প্রাপ্ত গ্যাস সম্পদকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উত্তোলনের মাধ্যমে গোটা দক্ষিণাঞ্চলকে গ্যাসের আওতায় এনে এখানে স্থাপন করা যায় একটি সার কারখানা। এছাড়াও এ গ্যাস দিয়ে ০২ টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছেঃ ০১। রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টঃ ৩৪.৫ মেঘাওয়াট এবং ০২। বোরহানউদ্দিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ ২২৫ মেঘাওয়াট। এছাড়াও রয়েছে ভোলার দক্ষিণে চর কুকরী মুকরী, ঢালচর, লতার চর ও চর নিজাম সহ অসংখ্য চর। নৈসর্গিক দৃশ্য সম্বলিত এ চরগুলো হতে পারে পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় স্থান।
সমস্যা ও সম্ভাবনার বেদীমূলে দাঁড়িয়ে আজকের ভোলা তাকিয়ে আছে সামনের পানে। খাদ্যে উদ্বৃত্ত ও রূপালী ইলিশ সমৃদ্ধ হলেও ঝড়-জ্বলোচ্ছাস ও নদী ভাঙ্গনের তান্ডবকে নিয়তির অমোঘ বিধান বলে মেনে নিয়েছে এখানকার মানুষ। তাই বলে তারা থেমে থাকেনি। একটি সুন্দর ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে তারা অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে সম্মুখের পানে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস